শেয়ারদর ওঠানামায় কোম্পানির ভূমিকাকে প্রাধান্য দিয়ে ভারতের আদলে তৈরি হচ্ছে বাইব্যাক আইন।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, বুকবিল্ডিং পদ্ধতির মতো বাইব্যাক আইনও পুঁজিবাজার বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। তাই আইনটি যেন কারসাজির হাতিয়ার না হয়ে ওঠে সেজন্য আইন প্রণয়নে সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।
অন্যান্য দেশে বাইব্যাক আইন থাকলেও বাংলাদেশের কোম্পানি আইনে ওই আইনের অনুমোদন নেই। তাই বাইব্যাক আইন করতে হলে প্রথমে কোম্পানি আইন সংশোধন করতে হবে।
সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনসহ (এসইসি) ঢাকা ও চট্রগ্রাম দুই স্টক এক্সচেঞ্জ বাইব্যাক আইনের প্রস্তাব নিয়ে কাজ করছে। আইনটিতে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শেয়ারদরের ওঠানামার ওপর কোম্পানির সাপোর্টের বিষয়টি প্রাধান্য পাবে।
বাইব্যাক আইনের উদ্দেশ্য:
আইন অনুযায়ী শেয়ারের বাইব্যাক যে উদ্দেশ্যে করা হয় সেগুলো হলো-
প্রথমত: উদ্যোক্তাদের শেয়ারের অংশ বাড়াতে আইনটি করা হচ্ছে। অর্থাৎ কোম্পানির মোট শেয়ারের মধ্যে যদি ৩০ শতাংশ উদ্যোক্তাদের হাতে এবং ৭০ শতাংশ শেয়ারহোল্ডারদের হাতে থাকে সেক্ষেত্রে বাইব্যাক করে উদ্যোক্তাদের শেয়ারের অংশ বাড়ানো হবে।
দ্বিতীয়ত: শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) বাড়াতে আইনটি কার্যকর করা হবে। অর্থাৎ কোম্পানি বাইব্যাক করলে বিনিয়োগকারীদের শেয়ার সংখ্যা কমে যাবে। এতে শেয়ারের ইপিএস বাড়বে।
তৃতীয়ত: কোম্পানির মূলধন অনেক বেড়ে গেলে তা কমাতে বাইব্যাক করা হবে।
চতুর্থত: শেয়ারের দর যৌক্তিক পর্যায়ে রাখার কাজে আইনটি ভূমিকা রাখবে। অর্থাৎ পরিস্থিতি অনুযায়ী কোম্পানি শেয়ার বাইব্যাক করে দর বাড়াতে অথবা কমাতে পারবে।
পঞ্চমত: কোম্পানির অলস অর্থ বেড়ে গেলে শেয়ার বাইব্যাক করতে পারবে।
কিভাবে বাইব্যাক করা হবে:
প্রথমত: কোম্পানির অতিরিক্ত রিজার্ভ থেকে বাইব্যাক করা হবে।
দ্বিতীয়ত: কোম্পানি শেয়ার থেকে যে অতিরিক্ত প্রিমিয়াম নিয়েছে সেই অর্থ থেকে বাইব্যাক করা হবে।
তৃতীয়ত: সাধারণ শেয়াহোল্ডারদের কাছে চিঠি দয়ে বাইব্যাক করা হতে পারে।
চতুর্থত: ওপেন মার্কেট থেকে বাইব্যাক করা হতে পারে।
পঞ্চমত: বুকবিল্ডিং পদ্ধতিতে এবং
ষষ্ঠত: স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে বাইব্যাক করতে পারবে।
বাইব্যাকের শর্ত:
কোম্পানি আইনে বাইব্যাক অনুমোদিত থাকতে হবে। কোম্পানির পরিশোধিত মূলধনের কমপক্ষে ২৫ শতাংশ বাইব্যাক করতে হবে। কোম্পানির ঋণের পরিমাণ পরিশোধিত মূলধন ও রিজার্ভের দ্বিগুণ হলে বাইব্যাক করতে পারবে না। কোম্পানি বাইব্যাক করার আগে শেয়ারহোল্ডারদের ডিভিডেন্ডসহ সকল ঋণ পরিশোধ করতে হবে।
বাইব্যাক করা সকল শেয়ার পরিশোধিত মূলধনে যুক্ত হবে। বোর্ডে সিদ্ধান্ত হওয়ার ১২ মাসের মধ্যে বাইব্যাক সম্পন্ন করতে হবে। বাইব্যাক সম্পন্ন হওয়ার পর পুনরায় বাজারে আসতে হলে তাকে পরবর্তী ৬ মাসের মধ্যে পাবলিক ইস্যু বা রাইট ইস্যু করে আসতে হবে।
কোম্পানি বাইব্যাক করতে চাইলে তাকে অবশ্যই ঘোষণা দিতে হবে এবং অন্তত: একটি ইংরেজি জাতীয় দৈনিক ও একটি বাংলা জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে হবে। ঘোষণায় বাইব্যাকের একটি নির্দিষ্ট তারিখ ও শেয়ারের প্রাইস উল্লেখ থাকতে হবে।
বিনিয়োগকারীদের ওপর বাইব্যাক আইনের প্রভাব:
বিনিয়োগকারীদের ওপর বাইব্যাক আইনের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দু’রকম প্রভাবই থাকবে বলে মনে করেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। কোম্পানি বাইব্যাক করলে শেয়ারের ইপিএস বেড়ে যাবে। এতে বিনিয়োগকারীরা লাভবান হবে। এছাড়া বাজারের পরিস্থিতি প্রেক্ষাপটেও বাইব্যাক আইন অনেক সহায়ক হবে। কোনো কোম্পানির শেয়ার দর অস্বাভাবিক কমে গেলে তখন কোম্পানি ওই শেয়ার বাইব্যাক করবে। এতে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।
এছাড়া কোনো কোম্পানি অতিরিক্ত প্রিমিয়াম নিয়ে বাজারে আসার পর শেয়ার দর পড়ে গেলে কোম্পানি বাইব্যাক করতে বাধ্য থাকবে। এতে বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকির মুখে পড়বে না।
শেয়ারবাজারের ওপর বাইব্যাকের প্রভাব:
শেয়ারবাজারের ওপর বাইব্যাকের প্রভাব থাকবে বলে মনে করেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। বাইব্যাক করার আগে কোম্পানিকে ঘোষণা দিতে হবে। এসময় কি দরে বাইব্যাক করা হবে তাও ঘোষণায় থাকবে। সেক্ষেত্রে এ ঘোষণা বাজারে ইতিবাচক ও নেতিবাচক হুজুগ সৃষ্টি করতে পারে। যেমন ফেসভ্যালু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বাজারে হুজুগ সৃষ্টি হয়েছিল।
এছাড়া বাইব্যাক আইনকে সরকার সাপোর্ট হিসেবে নিতে পারে। যেমন, বিপর্যয়কালে এ আইনের বলে শেয়ারদরকে সাপোর্ট দিতে কোম্পানিকে বাধ্য করতে পারবে সরকার।
বাইব্যাক আইন নিয়ে বাজার সংশ্লিষ্টদের অভিমত:
বাইব্যাক আইন এখন পুঁজিবাজারে প্রধান আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। তবে এ আইন যেন কারসাজির হাতিয়ার হয়ে না উঠতে পারে সেদিকে সতর্ক থাকতে পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ বুকবিল্ডিং একটি আধুনিক পদ্ধতি হওয়া সত্ত্বেও আইনের ফাঁক থাকায় তা বাজারে বিপর্যয় ডেকে এনেছে। বাইব্যাক আইনেও সতর্কতা অবলম্বন না করা হলে একই বিপর্যয় ঘটার আশংকা রয়েছে।
এ ব্যাপারে ডিএসই সভাপতি শাকিল রিজভী বলেন, বাইব্যাক আইন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট মাথায় রেখেই করতে হবে। এ আইনের মাধ্যমে কোম্পানিগুলো যেন কোনো অন্যায় সুযোগ নিতে না পারে সেদিকে খেয়ার রাখতে হবে। কারণ বাইব্যাক আইনের সুযোগ নিতে অনেক কোম্পানি ইচ্ছাকৃতভাবে কোম্পানির ইপিএস ও শেয়ারদর কমিয়ে দিতে পারে। পরে শেয়ার কিনে নেওয়ার পর আবারও ইপিএস ও শেয়ারদর বাড়িয়ে দিতে পারে। আবার অনেক কোম্পানি বাইব্যাক আইনের সুযোগে বেশি প্রিমিয়াম নিয়ে বাজারে আসার চেষ্টা করতে পারে। এসব দিক মাথায় রেখেই বাইব্যাক আইন প্রণয়ন করতে হবে। ডিএসই বাইব্যাক আইনের প্রস্তাব নিয়ে কাজ শুরু করেছে।
‘বাইব্যাক আইন অবশ্যই বাজারে সুফল বয়ে আনবে’ বলে মনে করেন চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) প্রেসিডেন্ট ফখরুদ্দীন আলী আহমেদ। তবে তিনি বলেন,‘তাড়াহুড়ো না করে সময় নিয়ে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো পর্যালোচনা করেই এ আইন প্রণয়ন করতে হবে।’
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
March 9, 2011