August 27, 2010

বাংলাদেশে কালো টাকা জিডিপির ৩৭ শতাংশ




১৯৯৯ সালে বাংলাদেশের কালো টাকা ছিল মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩৫ দশমিক ২ শতাংশ। আর এই হার বেড়ে সর্বশেষ ২০০৭ সালে দাঁড়িয়েছে ৩৭ শতাংশ।

বিশ্বের ১৫১টি দেশের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক বা ছায়া অর্থ, অর্থাৎ কালো টাকার পরিমাণের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৪তম। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি কালো টাকা জর্জিয়ায়, সাড়ে ৭২ শতাংশ এবং সবচেয়ে কম সুইজারল্যান্ডে, ৯ দশমিক ১ শতাংশ। সার্বিকভাবে সারা বিশ্বে গড়ে কালো টাকার হার ৩৪ দশমিক ৫ শতাংশ।

কালো টাকার সন্ধানে: অস্ট্রিয়ায় জোহানস কেপলার ইউনিভার্সিটি অব লিনজের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ফ্রেডারিক স্নেইডার ২০ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে কালো টাকা নিয়ে কাজ করছেন। ফ্রেডারিক স্নেইডারের সর্বশেষ প্রতিবেদনে কালো টাকার এই হিসাব পাওয়া যায়।

২০ বছর ধরে অস্ট্রীয় এই অধ্যাপক কালো টাকা নিয়ে কাজ করলেও বিশ্বের সব দেশকে নিয়ে এ সংক্রান্ত কাজটি শুরু হয়েছিল বিশ্বব্যাংক ও ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) সহায়তায়। প্রথম প্রতিবেদনটি প্রকাশ পায় ২০০২ সালে। ‘সাইজ অ্যান্ড মেজারমেন্ট অব দি ইনফরমাল ইকোনমি ইন ১১০ কান্ট্রিজ অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড’ নামের এই সমীক্ষা প্রতিবেদনটিই ছিল অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির ওপর ভালো, নির্ভরযোগ্য ও সবচেয়ে ব্যবহূত সমীক্ষা। এ থেকে কার কাছে কত কালো টাকা আছে, তার একটি ধারণা পাওয়া যায়। সমীক্ষাটি করা হয়েছিল বিশ্বব্যাংকেরই ‘ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করার ব্যয়’ নামের প্রকল্পের অংশ হিসেবে। তবে সমীক্ষায় ব্যবহূত তথ্য ছিল একটু পুরোনো। ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছরের মোট জাতীয় উত্পাদনে (জিএনপি) একটি দেশের অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির হার এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়।

তবে অনানুষ্ঠানিক বা কালো টাকার হিসাবটি প্রতিনিয়ত বদল হচ্ছে। ফলে সমীক্ষাটি প্রতিনিয়ত হালনাগাদ করার প্রয়োজন ছিল। এ কারণেই অধ্যাপক ফ্রেডারিক স্নেইডার বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় কালো টাকা-সংক্রান্ত সমীক্ষাটি হালনাগাদ করছেন। এ নিয়ে সর্বশেষ সমীক্ষা প্রতিবেদনটি প্রকাশ পেয়েছে গত জুলাই মাসে। এবারের সমীক্ষা প্রতিবেদনটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘শ্যাডো ইকোনমিজ অল ওভার দ্য ওয়ার্ল্ড: নিউ এস্টিমেটস ফর ১৬২ কান্ট্রিজ ফ্রম ১৯৯৯—২০০৭।’ নতুন সমীক্ষায় অধ্যাপক ফ্রেডারিক স্নেইডারের সঙ্গে ছিলেন আন্দ্রিয়াস বুয়েন ও ক্লডিও ই মন্টেনগ্রো।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছায়া বা কালো অর্থনীতি তৈরি হচ্ছে মূলত সরকারি কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও কর-কাঠামোর অব্যবস্থার কারণে। এতে অনেক মানুষ আনুষ্ঠানিক অর্থনীতির বাইরে থেকে যায়।
কালো টাকার পরিমাণ বের করার কাজটি শুরু হয়েছিল ১১২টি দেশ নিয়ে। এবার তথ্য দেওয়া হলো ১৬২টি দেশের। তবে ১৯৯৯ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত সব ধরনের তথ্য সমন্বয় করে ১৫১টি দেশের ছায়া অর্থনীতির তলিকা তৈরি হয়েছে। বাকি ১১টি দেশের পূর্ণাঙ্গ তথ্য নেই।

অর্থশাস্ত্রে কালো টাকার কোনো সংজ্ঞা পাওয়া যায় না। অর্থনীতিবিদেরা একে অনানুষ্ঠানিক (ইনফরমাল), গোপন (আন্ডারগ্রাউন্ড), অপ্রদর্শিত (ইনডিসক্লোজড), লুকানো (হিডেন) বা ছায়া (শ্যাডো) অর্থনীতি বলে থাকেন।

আয়কর বিবরণীতে যে আয় প্রদর্শন করা হয়নি, সেটাই অপ্রদর্শিত। এই অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ বা অবৈধ দুভাবেই অর্জিত হতে পারে। বৈধ আয় হয়েও আয়কর বিবরণীতে না দেখালে সেটি যেমন অপ্রদর্শিত আয়, তেমনি অবৈধ উপায়ে অর্জিত আয়ও অপ্রদর্শিত আয়। অবৈধ বা অনানুষ্ঠানিক অথবা অপ্রদর্শিত যা-ই বলা হোক না কেন, এটি আসলে কালো টাকাই।

কার কত কালো টাকা: সমীক্ষা অনুযায়ী, গড়ে সবচেয়ে বেশি কালো টাকা আছে লাতিন ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে, ৪২ দশমিক ১ শতাংশ। সাব-সাহারান আফ্রিকায় এই হার ৪১ দশমিক ৩ এবং ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ায় সাড়ে ৪০ শতাংশ। এর বাইরে সবচেয়ে বেশি কালো টাকা আছে দক্ষিণ এশিয়ায়, ৩৪ শতাংশ এবং পূর্ব এশিয়া ও প্যাসিফিকে ৩৩ দশমিক ৩ শতাংশ। আবার মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় এই হার সাড়ে ২৮ শতাংশ। তবে ধনী দেশগুলোতে কালো টাকার হার তুলনামূলকভাবে কম। ৩২টি ধনী দেশের সমন্বয়ে তৈরি ওইসিডির কালো টাকা ১৭ দশমিক ১ শতাংশ এবং এর বাইরের উচ্চ আয়ের দেশের কালো টাকা ২৩ দশমিক ৯ শতাংশ।

দেশ হিসেবে সবচেয়ে বেশি অনানুষ্ঠানিক অর্থের মালিক জর্জিয়া। এর পরের অবস্থান বলিভিয়ার, ৭০ দশমিক ৭ শতাংশ। শীর্ষ ১০-এর বাকি দেশগুলো যথাক্রমে আজারবাইজান (৬৯ দশমিক ৬ শতাংশ), পেরু (৬৬ দশমিক ৩), তানজানিয়া (৬৩), জিম্বাবুয়ে (৫৬ দশমিক ১), ইউক্রেইন (৫৭ দশমিক ৫) ও গুয়াতেমালা (৫৩ দশমিক ৯ শতাংশ)।

সবচেয়ে ভালো অবস্থানে থাকা সুইজারল্যান্ডের পরই আছে যুক্তরাষ্ট্র, দেশটির ছায়া অর্থনীতির হার ৯ শতাংশ। এর পরের আটটি দেশ হলো যথাক্রমে অস্ট্রিয়া (১০ দশমিক ১ শতাংশ), লুক্সেমবার্গ (১০ দশমিক ২), জাপান (১২ দশমিক ১), যুক্তরাজ্য (১৩. দশমিক ২), নেদারল্যান্ড (১৩ দশমিক ২), নিউজিল্যান্ড (১৩. দশমিক ৬), সিঙ্গাপুর (১৪) ও চীন (১৪ দশমিক ৩ শতাংশ)।
বাংলাদেশ পরিস্থিতি ও দক্ষিণ এশিয়া: ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশের কালো টাকা ছিল ৩৫ দশমিক ২ শতাংশ। ২০০০ সালে কালো টাকার হার বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৩৫ দশমিক ৬ শতাংশ, ২০০১ সালে ৩৫ দশমিক ৭, ২০০২ সালে ৩৫ দশমিক ৫, ২০০৩ সালে ৩৫ দশমিক ৬, ২০০৪ সালে ৩৫ দশমিক ৭, ২০০৫ সালে ৩৬, ২০০৬ সালে ৩৬ দশমিক ৭ এবং ২০০৭ সালে আরও বেড়ে হয় ৩৭ শতাংশ।

দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে ভারত। ৪২তম অবস্থানে থাকা ভারতের কালো টাকা ২৩ শতাংশ। ভুটানের অবস্থান ৫৮তম এবং দেশটির কালো টাকার হার জিডিপির ৩১ দশমিক ১ শতাংশ। ৬০তম অবস্থানে থাকা মালদ্বীপের কালো টাকা ৩২ দশমিক ১ শতাংশ। এর অনেক পরের অবস্থান নেপালের। ৯১তম অবস্থানে থাকা নেপালের কালো টাকা ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ৯২তম পাকিস্তানের ৪০ দশমিক ১ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে আছে শ্রীলঙ্কা। দেশটির মোট কালো টাকার হার ৪৭ শতাংশ।

প্রতিবেদনে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়, বিশ্বের প্রায় সব দেশেই অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়ছে। মানুষ নানাভাবে অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির প্রতি ঝুঁকছে। মূলত কর ও সরকারি নিয়ন্ত্রণের কারণেই এমনটি ঘটছে। আরেকটি উদ্বেগজনক দিক হচ্ছে, ধনী দেশগুলোতে অনানুষ্ঠানিক অর্থের পরিমাণ কম, দরিদ্র্য দেশগুলোতে বেশি।

মন্দা কালো টাকা বাড়িয়ে দিচ্ছে: প্রভাবশালী পত্রিকা দি ইকনমিস্ট-এর ১১ আগস্ট সংখ্যায় আবারও শিরোনামে স্থান করে নিয়েছেন অধ্যাপক ফ্রেডারিক স্নেইডার। ইকোনমিস্ট জানায়, সাম্প্রতিক বিশ্ব অর্থনীতির মন্দার পর বিশ্বব্যাপী ছায়া বা অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির পরিমাণ আরও বেড়েছে। ২০১০ সাল পর্যন্ত সময়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে অধ্যাপক ফ্রেডারিক স্নেইডার নতুন এই গবেষণ প্রতিবেদন তৈরি করেছেন।

প্রতিবেদেন বলা হয়েছে, বিশ্বমন্দার পর করের আওতার বাইরে থাকতে অর্থের লেনদেন অনেক বেড়েছে। এতে ছায়া অর্থনীতির
পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে উন্নত ও ধনী দেশগুলোতে এ প্রবণতা বেশি। ওইসিডি ও ইউরোপের মানুষ করের অতিরিক্ত ভার এড়ানোর জন্য অনানুষ্ঠানিক লেনদেনে আগ্রহী হয়ে উঠেছে বলে জানান ফ্রেডারিক স্নেইডার। তিনি অবশ্য বলেছেন, অনানুষ্ঠানিক এই লেনদেনের সব অর্থই যে খারাপ, তা বলা যাবে না। বরং বলা যায়, সময় যখন অনেক খারাপ থাকে, তখন এ ধরনের লেনদেনকে উত্তরণের একটি পথ হিসেবে অনেকে বেছে নিচ্ছেন।

অধ্যাপক ফ্রেডারিক স্নেইডার এ দফায় সম্ভবত ধনী দেশগুলোর পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেছেন। তাতে দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ব্রিটেন, জার্মানি, সুইডেন, স্পেন, ইতালি, গ্রিস, তুরস্ক, বুলগেরিয়া, এস্তোনিয়া ও লাটভিয়ার ছায়া অর্থনীতির পরিমাণ ২০০৮-এর তুলনায় ২০১০ সালে বেড়ে গেছে।

ফ্রেডরিক স্নেইডার ২০ বছর ধরে ছায়া বা অনানুষ্ঠানিক অর্থ নিয়ে কাজ করছেন। তা সত্ত্বেও তিনি মনে করেন, এখনো ছায়া অর্থনীতি, এর পরিমাণ, কারণ এবং এর প্রভাব সম্বন্ধে নির্ভুল তথ্য পাওয়া সহজ নয় এবং এখনো এসব নিয়ে বিতর্ক আছে। এ জন্য প্রয়োজন আরও বেশি গবেষণা। আর তাতেই বিশ্বব্যাপী কালো টাকা নিয়ে আরও নির্ভুল তথ্য পাওয়া যাবে বলেই তিনি মনে করেন।

বাংলাদেশেও কালো টাকা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা থাকলেও এর পরিমাণ ও কারণ নিয়ে দেশের মধ্যে ভালো কোনো গবেষণা নেই। আশির দশকে ভারতে এ নিয়ে বড় ধরনের গবেষণা হয়েছিল। বাংলাদেশে একদমই হয়নি। ফলে বাংলাদেশে আসলে কালো টাকার পরিমাণ কত, তা জানার এখন পর্যন্ত একমাত্র উপায় অধ্যাপক ফ্রেডারিক স্নেইডারের গবেষণা। কিন্তু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, দেশের মধ্যেই কালো টাকার পরিমাণ, উত্স এবং প্রভাব নিয়ে বড় আকারের সমীক্ষার প্রয়োজন রয়েছে।

* প্রথম আলো, ২৭ আগস্ট ২০১০

No comments: