গত অর্থবছরে তাক লাগানো প্রবৃদ্ধি ও দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রফতানি আয় হলেও চলতি অর্থবছরের শুরুতেই হতাশা। ত্রিমুখী চাপে পড়েছেন দেশের বস্ত্র খাতের ব্যবসায়ীরা। গত মার্চ থেকে তুলার দামে অব্যাহত পতনের কারণে বিদেশী ক্রেতারা নতুন ক্রয় আদেশ দিতে অপেক্ষা করছেন। ফলে পোশাক রফতানি খাতে নতুন ‘ক্রয় আদেশ মন্দা’ দেখা দিয়েছে।
আবার তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় ক্রেতা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহজীকৃত (রুলস অব অরিজিন) শিথিলতার কারণে ব্যাপক হারে কাপড়ের আমদানি বেড়েছে। যা এরই মধ্যে গত একদশকে স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা স্পিনিং ও উইভিং খাতের দুর্গতি তৈরি করেছে।
এদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আমদানি তথ্যের সর্বশেষ সংকলনে দেখা যায়, পশ্চাত্-সংযোগ স্পিনিং ও উইভিং শিল্প দেশেই বাজার হারাচ্ছে।
এনবিআরের তথ্যে দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে রফতানিমুখী পোশাক তৈরির কাপড় আমদানি হয়েছিল ৭৮ হাজার টন আর মার্চ-জুন প্রান্তিকে তা ৫৯১ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৫ লাখ ৩৯ হাজার টন। প্রথম প্রান্তিকে সুতার আমদানি ছিল ৫৪ হাজার টন আর দ্বিতীয় প্রান্তিকে তা বেড়ে হয়েছে ৯২ হাজার টন। প্রথম প্রান্তিকে নিট ফেব্রিক আমদানি ২২ হাজার টন, দ্বিতীয় প্রান্তিকে হয়েছে ৩৯ হাজার টন।
দেশের রফতানিমুখী পোশাক প্রস্তুতকারকদের কাছে স্থানীয় সুতা ও কাপড় উত্পাদকদের যে নিশ্চিত বাজার ছিল তাতে ভাগ বাড়াচ্ছে চীনা, ভারতীয়, পাকিস্তানি ও থাই রফতানিকারকরা।
রফতানি খাতের পর্যবেক্ষকরা বলছেন, তুলার মূল্যপতনে কাহিল বাংলাদেশী স্পিনিং ও উইভিং শিল্পের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশের সুতা ও কাপড়ের বাজার দখল করতে শিথিলকৃত এবং সিঙ্গেল স্টেজ ইইউ-জিএসপি রুলস অব অরিজিন সুবিধার সর্বোচ্চ ব্যবহার করছেন অন্য দেশের রফতানিকারকরা।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জাহাঙ্গীর আলামিন গতকাল বণিক বার্তাকে বলেন, শিথিলকৃত রুলস অব অরিজিন, তুলার দ্রুত মূল্যপতন আর অর্ডার কমে যাওয়ার ত্রিমুখী সংকটে স্থানীয় স্পিনিং ও উইভিং খাত স্মরণকালের সবচেয়ে গভীর সংকটে পড়েছে। তিনি জানান, প্রায় সব প্রতিষ্ঠানই এখন উত্পাদন গড়ে অর্ধেকই কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমার ২৮ বছরের ব্যবসায়িক জীবনে এমন গভীর সংকট দেখিনি। ত্রিমুখী সংকটে এখন স্থানীয় পশ্চাত্ সংযোগ শিল্পের ভবিষ্যত্ নিয়েই প্রচণ্ড শংকা দেখা দিয়েছে।’
উল্লেখ্য, এ বছরের জানুয়ারি থেকে বাস্তবায়িত শিথিলকৃত ও সিঙ্গেল স্টেজ ইইউ-জিএসপি রুলস অব অরিজিন পদ্ধতির কারণে বাংলাদেশ থেকে পোশাক নিয়ে ইউরোপীয় আমদানিকারকরা শুল্কমুক্ত সুবিধা নিতে পারেন যদি সে পোশাক আমদানিকৃত কাপড়েও তৈরি হয়। এর আগে ডাবল স্টেজ রুলস অব অরিজিনের বাধ্যবাধকতায় শুল্কমুক্ত সুবিধা পেতে বাংলাদেশ বা অন্য স্বল্পোন্নত দেশের পোশাক সে দেশেই উত্পাদিত কাপড় দিয়ে তৈরি হতো।
সে বাধ্যবাধকতার কারণে বাংলাদেশে নিট ফেব্রিক ও ডেনিম ফেব্রিক উত্পাদন শিল্পের ব্যাপক বিস্তার হয় আর সুতার বিশাল বাজারকে লক্ষ্য রেখে শক্তিশালী স্পিনিং খাত গড়ে ওঠে।
পশ্চাত্ সংযোগ শিল্পের উদ্যোক্তারা অবশ্য এ বছরের প্রথম প্রান্তিকেই জানিয়েছিলেন, ইইউ-জিএসপি শিথিল করায় সুতা ও কাপড়ের আমদানি বৃদ্ধির কারণে তারা অসম প্রতিযোগিতায় পড়েছেন।
তবে বছরের প্রথম দিকে দেশের স্পিনিং ও উইভিং খাত ব্যবসায় ততটা পড়তি টের পায়নি, কারণ তখনও বিদেশীে ক্রেতাদের কাছ থেকে প্রচুর অর্ডার আসতে থাকায় সুতা ও কাপড়ের চাহিদা ছিল।
সংশ্লিষ্টরা বণিক বার্তাকে বলেন, সম্প্রতি তুলার মূল্যপতনের আরও পড়তির আশায় ক্রেতারা অর্ডার কমিয়ে দিয়েছেন। আর চাহিদা মন্দায় স্থানীয় স্পিনিং ইউনিট, ডেনিম ও অন্যান্য উইভিং ইউনিটগুলোর ত্রাহি দশা।
গত মার্চের শেষে আন্তর্জাতিক বাজারে তুলার মূল্যবৃদ্ধি থেমে যায়। এর আগে এক বছরের মধ্যেই প্রায় তিনগুণ দাম বেড়ে তুলার পাউন্ড দুই মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছিল আর সুতার দাম দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে প্রতি কিলোগ্রাম ৭ ডলার ছাড়িয়েছিল।
গতকাল বৃহস্পতিবার তুলার দামও পাউন্ডে ১০০ সেন্ট বা ১ ডলারের নিচে নেমেছে। যদিও বাংলাদেশে টি-শার্ট তৈরির কমন ক্যাটাগরি, ৩০ কাউন্ট, সুতাও প্রতি কিলোগ্রাম ৪ ডলারে নেমে গেছে।
দ্রুত এ দরপতনে তাল মেলাতে পারেননি স্পিনাররা। কারণ তাদের অনেকেরই বেশি দামে কেনা সুতা মজুদে ছিল বা জাহাজে ছিল। এদিকে শিল্প সূত্রে জানা গেছে, বেশি দামে ঠিক করা তুলার চালান নিয়েও বিপাকে পড়েছেন স্থানীয় স্পিনাররা।
ব্রিটিশ, সুইসসহ সারাবিশ্বের মার্চেন্টদের কাছে তিন মাস আগের দরে যে তুলার অর্ডার চূড়ান্ত করেছিলেন স্থানীয় স্পিনাররা এখন আর সে দরে তুলা আনতে চাচ্ছে না। আগের দামে তুলা গ্রহণ না করার জন্য অনেক বাংলাদেশী স্পিনার ও তুলা আমদানিকারকের বিরুদ্ধে লন্ডনের ইন্টারন্যাশনাল কটন আর্বিট্রেশন কাউন্সিলে অভিযোগ তুলেছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তুলা ব্যবসায়ীরা।
ফলে অনেক আমদানিকারক কালো তালিকাভুক্ত হতে যাচ্ছেন। আর এটি হলে সরাসরি তুলা আনতে পারবেন না তারা। নিরুপায় হয়ে ফ্যাক্টরি চালাতে তুলার জন্য ট্রেডারনির্ভর হতে হবে। আর এতে তাদের উত্পাদন খরচ বেশি বাড়বে।
এদিকে নিট পোশাক রফতানিকারকরা বলছেন, গতবারের মতো প্রবৃদ্ধি তো দূরের কথা তুলা ও সুতার মূল্যপতনের প্রভাব থেকে
বাঁচিয়ে আনার সঠিক কৌশল এবং কার্যক্রম না নিতে পারলে বাংলাদেশের রফতানিমুখী পোশাক শিল্প ও এর পশ্চাত্ সংযোগ স্পিনিং শিল্পের সঙ্গে প্রতিযোগী দেশগুলোর অসম প্রতিযোগিতা নতুন মোড় নিতে
পারে। গত অর্থবছরের বাংলাদেশের পোশাক রফতানি আয়ে ৪৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়ে এক হাজার ৭৯১ কোটি মার্কিন ডলার বা এক লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা হয়েছিল।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্ততকারক ও রফতানিকারক সমিতির সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেন, শুধু তুলার বাড়তি মূল্যের পরিপ্রেক্ষিতে পোশাকের দাম বাড়ার কারণে গত অর্থবছরে এ খাতে রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধিতে যোগ হয়েছিল কমপক্ষে তিন বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা।
দু’বছর আগে চীনে উত্পাদন খরচ বৃদ্ধির জন্য পশ্চিমা ক্রেতারা তাদের ব্যবসা স্থানান্তর করেছিল বাংলাদেশে। এবার কাঁচামালে মূল্যপতনজনিত প্রভাবে দুর্বল হয়ে যাওয়া বাংলাদেশী রফতানিকারকদের অনেক ব্যবসা আবার ছিনিয়ে নিতে পারে ভারত, পাকিস্তান ও ভিয়েতনামসহ কিছু প্রতিযোগী দেশের রফতানিকারক এমন শংকা করছেন অনেক দেশী রফতানিকারক। মার্চের পর ভারত ও পাকিস্তানের পোশাক রফতানিতে ব্যাপক প্রবৃদ্ধি হয়েছে আর এর মাধ্যমে টের পাওয়া যাচ্ছে যে, বাংলাদেশ থেকে ছোট ছোট কিছু অর্ডার ভারত ও পাকিস্তানে চলে যাচ্ছে।
ব্রিটিশ একটি রিটেইলারের ঢাকা সোর্সিং অফিসে শীর্ষ পর্যায়ে কর্মরত একজন বাংলাদেশী কর্মকর্তাও গতকাল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘তুলা ও সুতার দ্রুত, ব্যাপক ও অব্যাহত মূল্যপতনের কারণে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানি খাত ও পশ্চাত্ সংযোগ স্পিনিং খাত সত্যিই বেশ ঝুঁকিপূর্ণ সময় পার করছে। তবে তিনি বলেন, বায়াররা বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাবে না। কারণ এখানে শ্রম সস্তা আর এখানকার শ্রমিকরা ভালো সেলাই করেন বলে তিনি মন্তব্য করেন।
বণিক বার্তা - 21 July 2011
No comments:
Post a Comment