ব্যাংকব্যবস্থায় সরকারের ঋণ সব পরিকল্পনাকে ছাপিয়ে গেছে। সদ্য সমাপ্ত ২০১০-১১ অর্থবছরে এই খাত থেকে নেওয়া ঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২০ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।
এই ঋণ অর্থবছরের মূল বাজেটের চেয়ে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা এবং সংশোধিত বাজেট লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে দুই হাজার কোটি টাকা বেশি।
সরকারের ঋণের প্রায় অর্ধেকটা এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে, অর্থাৎ নতুন টাকা ছেপে সরকারের চাহিদা মিটিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এ তসলিম ব্যাংক খাতে সরকারের ঋণ বৃদ্ধিতে সামষ্টিক অর্থনীতি ও বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ করায় দ্রব্যমূল্য বাড়বে। সরকারের এই ঋণের কারণে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমানও কমবে, ইতিমধ্যে তা কমতে শুরুও করেছে।’
বিগত অর্থবছরের বাজেটে বিদেশি সাহায্য পাওয়ার যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল, পাওয়া গেছে তার চেয়ে অনেক কম। আরও কয়েকটি কারণের সঙ্গে বৈদেশিক সাহায্য কম প্রাপ্তিও বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে নতুন করে চাপ তৈরি করেছে। আর বছরের শেষ মাসে সরকারের বড় ঋণের দায় গোটা মুদ্রা ব্যবস্থাপনাকে বাধাগ্রস্ত করেছে বলেও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
অধ্যাপক এম এ তসলিম বলেন, ‘কার্যত এখন রাজস্বনীতির আওতাভুক্ত হয়ে গেছে মুদ্রানীতি। পৃথকভাবে মুদ্রানীতির কোনো স্বকীয়তা, কার্যকারিতা থাকছে না।’ তিনি বলেন, রাজনৈতিক সরকারের ইচ্ছার কাছে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে কোনো কিছু করা দুষ্কর হয়ে পড়েছে।
সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরের শেষ মাসেই সরকারকে ব্যাংক থেকে সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকার মতো অর্থ ঋণ করতে হয়েছে। জুন শেষে তথ্য-উপাত্তে দেখা যায়, ব্যাংকব্যবস্থায় সরকারের নিট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার ৩৯১ কোটি ৩২ লাখ টাকা। অথচ ২০০৯-১০ অর্থবছরের একই সময়ে নিট ঋণের পরিমাণ ছিল ঋণাত্মক। অর্থাৎ, এর আগের বছরের চেয়ে চার হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা কম।
বাজেট ঘাটতি মেটাতে ঋণ: ২০১০-১১ অর্থবছরের মূল বাজেটে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারের নিট ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৫ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা। কিন্তু চলতি ২০১১-১২ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপনের সময় সংশোধিত বাজেটে এই ঋণ বাড়িয়ে ১৮ হাজার ৩৭৯ কোটি টাকা করা হয়।
মূল বাজেটে জাতীয় সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে জনগণের কাছ থেকে আট হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। কিন্তু সঞ্চয়পত্রে মুনাফার পরিমাণ কম থাকায় বিনিয়োগকারীরা সরকারের কাছে অর্থ খাটাতে অনাগ্রহ দেখিয়েছেন। জুলাই থেকে মে—এই ১১ মাসে এই খাতে সরকারের নিট ঋণ দাঁড়িয়েছে মাত্র দুই হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা।
অন্যদিকে ২০১০-১১ অর্থবছরের মে পর্যন্ত বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে ৪৮৪ কোটি ডলারের বৈদেশিক সাহায্য পাওয়ার অঙ্গীকার থাকলেও এপ্রিল পর্যন্ত ১৪০ কোটি ৬০ লাখ ডলার ছাড় পেয়েছে বাংলাদেশ।
সরকারের ঋণের খাত: অর্থবছর শেষে সরকারের ব্যাংকব্যবস্থা থেকে নেওয়া ঋণের প্রায় অর্ধেক টাকা এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে। ৩০ জুনের স্থিতিতে দেখা যাচ্ছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নিট ঋণের পরিমাণ নয় হাজার ৬৪১ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। অন্যদিকে তফসিলি ব্যাংকগুলো থেকে সরকারের নিট ঋণ দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৭৪৯ কোটি ৯৬ লাখ টাকা।
নতুন অর্থবছর শুরুর আগেই ২০১০-১১ অর্থবছরের বাজেটের একটা বড় অঙ্কের টাকা গত জুনে বিভিন্ন প্রকল্পের নামে ছাড় হয়ে ব্যাংকব্যবস্থায় বিশেষ করে তফসিলি ব্যাংকগুলোতে ঢুকেছে। ফলে তফসিলি ব্যাংক খাতে সরকারের নিট ঋণ অনেক কমে গেছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে জুন শেষে সরকারের ২৩ হাজার ২৯০ কোটি ৩০ লাখ টাকার আমানত জমার তথ্য পাওয়া যায়। এই আমানত বাদ দিয়েই বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সামগ্রিক ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ঋণ দেখানো হয়েছে ২০ হাজার ৩৯১ কোটি ৩২ লাখ টাকা।
সরকারের ঋণের প্রভাব: সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরের যে সময় সরকার ব্যাংকব্যবস্থা থেকে বড় অঙ্কের ঋণ করে, সেই সময়টায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতিকে আটকে রাখতে ঋণ নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপের মধ্যে ছিল, যার কারণে বেসরকারি খাত এই সময়ে তাদের চাহিদামতো ঋণ পায়নি—এমন অভিযোগ করেছে শিল্প ও বণিক সমিতিসমূহের ফেডারেশন এফবিসিসিআইসহ বাণিজ্য সংগঠনগুলো। যদিও মে মাস পর্যন্ত বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি আগের বছরের চেয়ে ২৭ দশমিক ৫০ শতাংশ বেশি। তার পরও বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুসারে গত অর্থবছরের শেষ দুই মাসে (মে, জুন) বেসরকারি খাতের ঋণের গতি নিম্নমুখী ছিল।
সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ করলে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রাপ্তির পরিমাণ কমে আসে। আর সরকার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরাসরি ঋণ নিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নতুন টাকা ছেপে সরকারের চাহিদা মেটাতে হয়। টাকা ছাপলে মূল্যস্ফীতি বাড়ে।
এসব বিষয়ে এম এ তসলিম আরও বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণকে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন অর্থ বলা হয়। সরকার এক টাকা ঋণ নিলে মুদ্রা সরবরাহ বাড়ে চার টাকা। তিনি বলেন, গত বছর মুদ্রা সরবরাহ বেড়েছিল ২২ শতাংশ। এবার জুন শেষের হিসাবে আবারও একই পরিমাণ বা তার চেয়ে বেশি মুদ্রা সরবরাহ বাড়ার তথ্য পাওয়া যাবে। এতে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে আরও পিছিয়ে পড়তে হবে। টাকার মূল্যমান কমবে।
অধ্যাপক তসলিম মনে করেন, ‘আগামী সময়ে আমদানি কমবে না বরং বাড়বে। রপ্তানি যদি ঠিকও থাকে, প্রবাসী-আয়ের (রেমিট্যান্স) প্রবৃদ্ধি সমাপ্ত বছরের চেয়ে বেশি করা যাবে বলে মনে হয় না, বরং কমতে পারে। কেননা, নতুন শ্রমবাজারের কোনো অগ্রগতির তথ্য পাচ্ছি না।’
প্রথম আলো ১৬-০৭-২০১১
No comments:
Post a Comment