July 23, 2011

সরকারই খালি করছে ব্যাংকের ভাণ্ডার

সরকারি বন্ড কেনাবেচার কোনো বাজার নেই। এসব বন্ড ও বিলের বিপরীতে পেনশন বা মিউচ্যুয়াল ফান্ড থেকে টাকা নেওয়ারও সুযোগ নেই ব্যাংকগুলোর। অথচ ট্রেজারি বিল বা বন্ডের নামে কিছু কাগজ ধরিয়ে দিয়ে নির্বাচিত ১৫টি প্রাইমারি ডিলার (পিডি) ব্যাংক থেকে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়ে খরচ করছে সরকার। আর কলমানি মার্কেট থেকে চড়া সুদে ধার করে ব্যাংকগুলোকে তাদের দৈনন্দিন লেনদেন সারতে হচ্ছে। এ কারণে সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে তারল্য থাকলেও নগদ অর্থের সংকটে এ ১৫টি ব্যাংকের মুখ থুবড়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানান বাংলাদেশ ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তারা।

সরকারের সিকিউরিটিজ (ট্রেজারি বিল ও বন্ড) ক্রয়ের নিলামে অংশগ্রহণের জন্য যেসব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচিত হয়েছে, সেগুলো প্রাইমারি ডিলার ব্যাংক হিসেবে পরিচিত। এ রকম ১৫টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সরকার তার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য ট্রেজারি বিল ও বন্ডের বিনিময়ে ঋণ নিয়ে থাকে। সরকার যত টাকা ঋণ নিতে আগ্রহী, তা পিডি ব্যাংকগুলো সিকিউরিটিজ কিনে জোগান দিতে বাধ্য। সরকার এসব সিকিউরিটিজ ক্রয়ের জন্য পিডি ব্যাংকগুলোকে কিছু সুবিধা প্রদান করে থাকে। কিন্তু এ দেশে তা হচ্ছে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রাইমারি ডিলার হিসেবে নির্বাচিত ১৫টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে। প্রাইমারি ডিলার ব্যাংকস অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা গেছে, নগদ টাকা নিয়ে ব্যাংকগুলোকে ট্রেজারি বিল ও বন্ড হিসেবে সরকারের দেওয়া এ তরল সম্পদ ব্যাংকগুলোর কাছে শুধু কাগুজে তারল্য, বাস্তবে তা কোনো কাজেই আসছে না। উচ্চ কলমানি রেট এবং আমানতের সুদের যুগে এ টাকার বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে লাভ নয়, শুধু লোকসানই গুনতে হচ্ছে। নিজের হাতে বিপুল তরল সম্পদ রেখেও ব্যাংকগুলোকে উচ্চ সুদে টাকা ধার করার জন্য হন্যে হয়ে ছুটতে হচ্ছে। নতুন করে ঋণ সম্প্রসারণ দূরের বিষয়, চলতি ঋণগুলোকে সচল রাখতেও তারল্য সরবরাহ করতে পারছে না ব্যাংকগুলো।
এর ওপর 'মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা' হিসেবে দেখা দিয়েছে নতুন বাজেটে আবারও ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের ঘোষণা। এ অর্থবছরে সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ধার নেবে ১৮ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা। যেকোনো মূল্যেই হোক পিডি ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে এ টাকা সরকারকে তুলে দিতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংককে। আর তা হলে ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট আরো বেড়ে গিয়ে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার পাশাপাশি দেশের শীর্ষস্থানীয় এসব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মুখ থুবড়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। পিডি ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে জানা গেছে, বেসরকারি খাতের উত্তরা ব্যাংক গত ১৯ জুলাই কলমানি মার্কেট থেকে ১২ শতাংশ সুদে ৫৪৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা ধার করেছে। একই সঙ্গে প্রিমিয়ার ব্যাংক থেকে ৯৮ কোটি টাকা এবং ইস্টার্ন ব্যাংক থেকে ৩০ কোটি ১৫ লাখ টাকা ১৩ শতাংশ রেপোর মাধ্যমে সুদে ধার করেছে। সরকারি মালিকানাধীন জনতা ব্যাংক একই দিনে ১২ শতাংশ সুদে কলমানি মার্কেট থেকে ৩৭৫ কোটি টাকা ধার করেছে। একই সঙ্গে ব্যাংকটি স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক থেকে ১২১ কোটি ৫৩ লাখ টাকা ১২ শতাংশ সুদে রেপোর মাধ্যমে ধার করেছে। ওই দিন অগ্রণী ব্যাংক সর্বোচ্চ ৬৬৬ কোটি টাকা কলমানি থেকে ১২ শতাংশ সুদে ধার করেছে এবং স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক থেকে ব্যাংকটি রেপোর মাধ্যমে নিয়েছে ৯৭ কোটি ২১ লাখ টাকা। প্রায় সব প্রাইমারি ডিলার ব্যাংকের একই অবস্থা। ধার করেই ব্যাংকগুলো তাদের দৈনন্দিন ব্যাংকিং কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অভিমত, এ সংকটের জন্য এককভাবে সরকারই দায়ী। সরকার পিডি ব্যাংকগুলোর কাছে সিকিউরিটিজ শুধু বিক্রিই করে চলেছে, কিন্তু এর বিপরীতে পিডি ব্যাংকগুলোকে এসব সিকিউরিটিজ বিক্রির জন্য বাজার (সেকেন্ডারি মার্কেট) তৈরি করে দিতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে পিডি ব্যাংকগুলো বাধ্য হয়ে শুধু সরকারের সিকিউরিটিজ কিনেই চলেছে, কিন্তু তা অন্য কোনো পক্ষের কাছে বিক্রি করতে পারছে না। ফলে ব্যাংকগুলোর হাতে থাকা সরকারি সিকিউরিটিজের তরল স্বভাব হারিয়ে কাগুজে তরলে রূপান্তর হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন সময়ে ট্রেজারি বিল ও বন্ড ছেড়ে ১৯ এপ্রিল পর্যন্ত সরকার প্রাইমারি ডিলার ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে ৪১ হাজার ১৯০ কোটি টাকা নিয়েছে, যার মধ্যে বিধিবদ্ধ জমা (স্ট্যাটেচুরি লিকুইডিটি রেশিও_এসএলআর) হিসেবে পিডি ব্যাংকগুলোর প্রয়োজন মাত্র ২১ হাজার ২৮৩ কোটি টাকা। ফলে বাকি ১৯ হাজার ৯০৬ কোটি টাকার বিল ও বন্ডই ব্যাংকগুলোর কাছে অপ্রয়োজনীয়। কারণ, প্রথমত প্রয়োজনে এ বিল ও বন্ড জমা দিয়ে (রেপোর মাধ্যমে) ব্যাংকগুলো তাদের প্রয়োজনীয় নগদ টাকা পাচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, এসব বিল ও বন্ডের মাধ্যমে সরকারকে দেওয়া ঋণ থেকে ব্যাংকগুলো সুদ পাচ্ছে ৮ থেকে ৯ শতাংশ। অন্যদিকে ব্যাংকগুলোর এ টাকা যেহেতু আমানতকারীদের টাকা এবং বর্তমানে আমানতের বিপরীতে সুদ হার সর্বোচ্চ ১২ শতাংশ, সেহেতু এ টাকার জন্য ব্যাংকগুলোকে ১২ শতাংশ হারে সুদ দিতে হচ্ছে। অর্থাৎ সরকারকে ঋণ দিয়ে পিডি ব্যাংকগুলোকে লোকসান গুনতে হচ্ছে ৩ থেকে ৪ শতাংশ।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, 'ব্যাংক কম্পানি আইন অনুযায়ী সরকারের দেওয়া গ্যারান্টিকে তরল সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। তাই সরকারের দেওয়া বিল ও বন্ড তরল সম্পদ। এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকও বাজারে তারল্য হিসাবায়নের সময় এ টাকাকে অন্তর্ভুক্ত করে। কিন্তু বাস্তবে চিত্র ভিন্ন, ব্যাংকগুলোর হাতে থাকা এসব সিকিউরিটিজের কোনো ক্রেতা নেই। এ ক্রেতা সৃষ্টির দায়িত্ব এককভাবে সরকারেরই। আমাদের কাছে ব্যাংকগুলো এসব সিকিউরিটিজের বিপরীতে নগদ টাকা চাইলে (রেপো চাইলে) আমরা মনিটরি পলিসি অনুযায়ী রেপো দেই। কখনো ১০০ কোটি টাকা চাইলে দেখা গেছে আমাদের কাছ থেকে তারা মাত্র ২০ থেকে ২৫ কোটি টাকা পায়, যা দিয়ে ব্যাংকের নগদ চাহিদা সম্পূর্ণ পূরণ করা সম্ভব হয় না। যেহেতু এগুলো সরকারি সিকিউরিটিজ, সরকারকেই যত দ্রুত সম্ভব সেকেন্ডারি মার্কেট তৈরিতে এগিয়ে আসতে হবে। নইলে ভবিষ্যতে তারল্য সংকট নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।' তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক বারবার সরকারকে সেকেন্ডারি মার্কেট সৃষ্টির জন্য তাগাদা দিয়ে আসছে। অর্থসচিব ড. মোহাম্মদ তারেকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ক্যাশ ও ডেব্ট ম্যানেজমেন্ট কমিটির (সিডিএমসি) বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে সেকেন্ডারি মার্কেট তৈরির জন্য বিদ্যমান সরকারের আইন পরিপালন করতে বারবার বলা হলেও তাতে কোনো কাজ হয়নি।

বিদ্যমান আইন অনুযায়ী, পুঁজিবাজারের মিউচ্যুয়াল ফান্ডেও একটি নির্দিষ্ট অংশ সরকারি সিকিউরিটিজে বিনিয়োগের কথা থাকলেও তা হয়নি। যেমন নবগঠিত মিউচ্যুয়াল ফান্ড 'বাংলাদেশ তহবিল'-এর ২৫ শতাংশ সরকারি সিকিউরিটিজে বিনিয়োগের কথা, কিন্তু তা করা হয়নি। ট্রাস্ট অ্যাক্ট অনুযায়ী সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সব ট্রাস্টের অর্থ সরকারি সিকিউরিটিজ তথা সরকারের ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ করার বিধান থাকলেও কেউ তা মানছে না। বরং বেশির ভাগ ট্রাস্টের অর্থই মেয়াদি আমানত তথা এফডিআরে বিনিয়োগ হচ্ছে এবং সরকার এ ক্ষেত্রে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। ইউরোপ-আমেরিকা থেকে শুরু করে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ বিশ্বের সব দেশেই সরকারের সব পেনশন ফান্ড ফান্ডেড এবং সেগুলো সরকারি সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশেই একমাত্র পেনশন ফান্ড নন-ফান্ডেড, ফলে তা সিকিউরিটিজে বিনিয়োগের সুযোগ নেই। এসব বিষয় বারবার বাংলাদেশ ব্যাংক সিডিএমসির বৈঠকে উপস্থাপন করলেও সরকার তা আমলে নিচ্ছে না।

এ বিষয়ে পিডি ব্যাংকগুলোর অ্যাসোসিয়েশন প্রাইমারি ব্যাংক ডিলারস বাংলাদেশ লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বেলায়েত হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, পিডি ব্যাংকগুলো খুবই বিপদের মধ্যে রয়েছে। এর অন্যতম কারণ সেকেন্ডারি মার্কেট নেই। ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কোনো সিকিউরিটিজ ক্রয়ের মাত্র দুই মাস সময় পর্যন্ত শতভাগ রেপো সহযোগিতা পায়। কিন্তু ব্যাংকগুলোর হাতে থাকা সিকিউরিটিজগুলোর বেশির ভাগই দুই মাসের আগে কেনা। তাই সেকেন্ডারি মার্কেট না থাকায় এবং বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রেপো সহযোগিতা না পাওয়ায় এসব সিকিউরিটিজ ব্যাংকগুলোর এ তারল্য সংকটে কোনো কাজে আসছে না। উপরন্তু সরকার নতুন করে এসব পিডি ব্যাংক থেকে ঋণ করবে। সব মিলিয়েই পিডি ব্যাংকগুলো এখন বড় ধরনের বিপদের মধ্যেই আছে। তিনি বলেন, সরকারের উচিত ট্রেজারি বিল ও বন্ডেও সুদ হার বাড়ানো। বাজারে বর্তমানে আমানতের সুদ হার ১২ শতাংশ। অন্যদিকে ট্রেজারি বন্ডেও সর্বোচ্চ সুদ হার ১০ শতাংশের অনেক কম। এ অবস্থায় পিডি ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে লোকসান দিয়ে কেউ সরকারি সিকিউরিটিজ কিনবে কেন?

উল্লেখ্য, বর্তমানে ১৫টি প্রাইমারি ডিলার ব্যাংক রয়েছে। এদের ১২টি ব্যাংক ও তিনটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এগুলো হচ্ছে সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, যমুনা ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, উত্তরা ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, এবি ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, লঙ্কাবাংলা ফিন্যান্স, আইপিডিসি এবং আইডিএলসি। এদের ১৪টি পিডিবিএলও সদস্য হলেও আইডিএলসি সদস্য নয়।

কালের কণ্ঠ 23.07.2011

No comments: